যেভাবে তুমি ভালো ছাত্র হতে পারবে
ভালো ফলাফলের জন্য প্রতিটি ছাত্র বা ছাত্রীকে নিজের সামর্থ ও দুর্বলতা সম্পর্কে জানতে হবে। কেউ মুখস্থ বিদ্যায় পারদর্শী, কেউ মুখস্থ করার চেয়ে বিষয়বস্তু বুঝতে চান, কেউ অল্প সময়ে মুখস্থ করতে পারে, কেউ মুখস্থ করতে সময় বেশি নেয়, কেউ অংকে ভালো, কেউ ইংরেজিতে ভালো-এভাবে এক একজনের সামর্থ এক এক রকম হতে পারে। তাই ছাত্রজীবনে সফল হতে হলে প্রথমেই ছাত্র/ছাত্রীকে জানতে হবে কীসে তার সামর্থ আছে এবং কোথায় তার দুর্বলতা রয়েছে। কেননা পড়ালেখার যাবতীয় পরিকল্পনা নির্ভর করে স্বীয় সামর্থ ও দুর্বলতা জানার উপর নির্ভর করে।
ভালো ছাত্রর মাঝে লুকানো শক্তি
পৃথিবীর বহু মনীষী একাধিক বার বলেছেন, মানুষের মাঝেই বিপুল শক্তি ও সত্যের সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে। মানুষের উচিত সেই শক্তি ও সম্ভাবনা সম্পর্কে অবগত হওয়া। যে ব্যক্তি নিজের শক্তি ও সম্ভাবনা সম্পর্কে অজ্ঞাত থাকে ওই সকল শক্তির সম্ভাবনার সর্বোত্তম ব্যবহার সে নিশ্চিত করতে পারে না। পরিণামে ওই ব্যক্তির ব্যর্থতার ঘানি টানতে টানতে মৃত্যুর দিকে অগ্রসর হয়। নিজের মাঝে যে আর একজন অচেনা, অজানা ‘আমি’ আছে তাকে জানাই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জানা এবং সব জানার সার জানা।
_____________
১. ডেল কার্নেগী ‘‘সুপ্তশক্তি ও ঘুমন্ত প্রতিভা’’- পৃষ্ঠা ১১
প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিত্ব সক্রেটিস তার শিষ্যদেরকে সবসময় বলতেন, ‘‘know thyself’’ অর্থাৎ নিজেকে জানো।
মনীষী সেফারসেন বলেছেন, ‘‘যে নিজেকে জানে - সে সবকিছুই জানে।’’
লালন শাহ-এর মতে, ‘‘একবার আপনারে চিনলে পরে যায় অচেনারে চেনা।’’
মিক্লে বলেছেন, ‘‘যে নিজেকে চিনতে পেরেছে - তার আর কাউকে চিনতে বাকি নেই। সে মিথ্যেকে চিনে এবং সে আদি সত্যকেও চিনতে পেরেছে। অতএব এ জগতে সে মানবজীবনের প্রকৃত কর্মটি চিনে নিয়েছে। সত্য নিত্যদিন তার মনে নব নবরূপে দোলা দেয় এবং মিথ্যের ভয়ে মিছেমিছে সে আর শঙ্কিত হয় না।’’
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর বাণী, ‘‘যে ব্যক্তি নিজেকে চিনতে পেরেছে - সে স্বয়ং আল্লাহকে চিনতে পেরেছে।’’
মহানবীর মহাসত্য বাণী ও সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছে যে মানুষ নিজেকে চিনতে পারলে জগত ও জগত স্রষ্টা উভয়কেই চিনতে পারবে।
ছাত্র-ছাত্রীদেরকে নিজের সম্পর্কে জানতে হবে। কেননা ভালো ফলাফল সম্পূর্ণভাবে ছাত্রর নিজের কর্মের উপর নির্ভর করে। শিক্ষাবর্ষের শুরুতেই ভালো ছাত্রকে শিক্ষার উদ্দেশ্যে, শিক্ষা কাঠামো, পরীক্ষা পদ্ধতি, পরীক্ষার ধরন, অধ্যয়ন পদ্ধতি, আবশ্যক বইপত্র, বইপত্রের প্রাপ্তি স্থান, বিষয়ের বিশেষজ্ঞ শিক্ষক কারা ইত্যাদি নানাবিধ বিষয় সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে হয়।
তুমি কতটা ভালো ছাত্র/ছাত্রী?
নিম্নের প্রশ্নগুলোর কাঙ্ক্ষিত উত্তর পাওয়া গেলে বুঝা যাবে তুমি ভালো ছাত্র। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত উত্তর পাওয়া না গেলে ভালো ছাত্র হওয়ার জন্য তোমাকে নানা কৌশল ও পন্থা অবলম্বন করতে হবে। যা এ পোস্টে বিশদভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। প্রশ্নগুলো নিম্নরূপঃ
ক্র. নংঃ
প্রশ্ন
কাঙ্ক্ষিত উত্তর
১. প্রতিদিনের কাজ সম্পর্কে তোমার কি কোনো পরিকল্পনা আছে?
হ্যাঁ
২. যদি থাকে, তুমি কি তাতে অনড় থাক?
হ্যাঁ
৩. অধ্যয়নের শুরুর দিকে কাজকর্ম ঠিক করতে তুমি কি অসুবিধার সম্মুখীন হও?
না
৪. তুমি কি সময়মতো তোমার কাজ করো?
হ্যাঁ
৫. তুমি কি তোমার কাজে উৎসাহ পাও?
হ্যাঁ
৬. তুমি কি ক্লাসের আলোচনায় অংশগ্রহণ করো?
হ্যাঁ
৭. তুমি কি ক্লাসরুমে পেছনে বসার চেষ্টা করো?
না
৮. যখন তুমি তোমার কাজ নিয়ে অসুবিধায় পড় তখন এ বিষয়ে তুমি কি তোমার শিক্ষকের সাথে কথা বলো?
হ্যাঁ
৯. কোনো অধ্যায় বিশদভাবে পড়ার পূর্বে তুমি কি অধ্যায় সম্পর্কে প্রাথমিক জরিপ করো?
হ্যাঁ
১০. পড়ার সময় তুমি কি বিভিন্ন টেবিলও চিত্র বাদ দিয়ে পড়?
না
১১. তুমি কি কোনো একটি একটি বিষয়ে সামগ্রিক নোট সংগ্রহ করো?
হ্যাঁ
১২. তুমি কি সাধারণত আউটলাইন মাফিক ক্লাস নোট সংগ্রহ করো?
হ্যাঁ
১৩. পড়ার সময় তার সারসংক্ষেপ প্রণয়নে তুমি কি তোমার বুঝার মতো সহজ চার্ট, চিত্র ও টেবিল প্রস্তুত করো?
হ্যাঁ
১৪. লেখার সময় নিজেকে প্রকাশ করতে তোমার কি অসুবিধা হয়?
না
১৫. অপ্রত্যাশিতভাবে কোনো পরীক্ষা নিলে তুমি কি তাতে ফেল করো বা কম নম্বর পাও?
না
১৬. তুমি কি কোনো পরীক্ষার জন্য বিলম্বে প্রস্তুত হতে বসো?
না
১৭. পরীক্ষার পূর্ব রাতে তুমি কি কোনো কোর্সের অধিকাংশ পড়া রিভিশন দাও?
না
১৮. তুমি কি পর্যাপ্ত ঘুমাও?
হ্যাঁ
১৯. বিনোদনের জন্য প্রতিদিন তুমি কি কিছু ঘণ্টা ব্যয় করো?
হ্যাঁ
২০. তোমার পড়ার টেবিলে ২ ফুট বাই ৪ ফুট খালি জায়গা আছে কি?
হ্যাঁ
ভালো ছাত্রর মাঝে লুকিয়ে থাকা শক্তি
প্রত্যেক মানুষের মাঝেই জন্মগতভাবে চারটি শক্তি লুকিয়ে থাকে। যেগুলো তার জীবনের মহামূল্যবান সম্পদ। শক্তিগুলো নিম্নরূপ :
[ক] চিন্তাশক্তি (Thinking power)
[খ] ইচ্ছাশক্তি (Will power)
[গ] দৈহিকশক্তি (Physical power/ Strength)
[ঘ] মননশক্তি (Power of your soul)
____________________
২. Dale Carnegie— ‘‘The unknown you within you’’ - পৃষ্ঠা ৯
[ক] চিন্তা-শক্তি
কিভাবে কোনো ব্যক্তির মঙ্গল হতে পারে তার পথ নির্দেশ করে চিন্তাশক্তি। চিন্তাশক্তির মাঝে আছে উদ্ভাবনী শক্তি বা আবিষ্কারক শক্তি। মানুষ প্রতিনিয়ত নিজের মঙ্গল ও কল্যাণ কামনা করে। কে দেবে তার পথ নির্দেশ? এর উত্তর হচ্ছে চিন্তাশক্তি। মানুষকে মঙ্গল পথের নির্দেশ এবং মঙ্গল পথের নির্দেশ এবং মঙ্গল পথের সন্ধান দেবে চিন্তাশক্তি। সেই মঙ্গল পথে কিভাবে চলতে হবে তারও খুঁটিনাটি নির্দেশ দেবে চিন্তাশক্তি।
ছাত্রজীবনে চিন্তাশক্তির গুরুত্ব অনেক বেশি। গভীর চিন্তার মাধ্যমেই নির্ভুলভাবে যেকোনো বিষয় উপস্থাপন করা যায়। নতুন নতুন ধারণার জন্ম দেওয়া যায়। সৃজনশীলতা ও স্বকীয়তা বজায় রাখার জন্যও চিন্তাশক্তির প্রয়োজন।
‘‘চিন্তাশক্তি এবং কল্পনাশক্তি জীবন যাত্রা নির্বাহের পক্ষে দুইটি অত্যাবশ্যক শক্তি তাহাতে আর সন্দেহ নাই। অর্থাৎ যদি মানুষের মতো মানুষ হইতে হয় তবে ওই দুটি পদার্থ জীবন হইতে বাদ দিলে চলে না। অতএব বাল্যকাল হতে চিন্তা ও কল্পনা চর্চা না করলে কাজের সময় তাকে হাতের কাছে পাওয়া যাইবে না।’’
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
একই প্রসঙ্গে শ্রী ক্ষিতিশ নাথ ঘোষ বলেছেন,
‘‘মানুষের যত প্রকার শক্তি আছে, তন্মধ্যে চিন্তাশক্তি প্রধান। এই শক্তি দ্বারা মানুষ দেবত্ব লাভ করিতে পারে - অসাধ্য সাধন করিতে পারে। চিন্তার গভীরতা ও ঐকান্তিকতার উপর তার ফলাফল নির্ভর করে।’’
মনীষী বায়রণও একই সুরে বলেছেন,
‘‘চিন্তাশক্তির প্রখরতা মানুষের মনের অলৌকিক পরিবর্তন আনতে পারে।’’
চিন্তাশক্তির প্রকারভেদ
Guilford (১৯৬৭) চিন্তাশক্তিকে ৫ ভাগে বিভক্ত করে দেখিয়েছেন। যেমন -
১. ধীশক্তি (Understanding)
২. স্মৃতি (Memory)
৩. এককেন্দ্রাভিমুখী চিন্তা (Convergent thinking)
৪. বহুমুখী চিন্তা (Divergent thinking)
৫. মূল্যায়ন (Evalution)
________________________________
৩. Preparing to teach Reading by Grayce A, Ransom. Littie, Brown & Company, Boston,P-7.
১. ধীশক্তি/বুদ্ধি (Understanding)
কোনো চিহ্ন (Symbols), ছাপার অক্ষর ও বাক্যের অর্থ অনুধাবনের জন্য একজন পাঠক তার জীবনের অভিজ্ঞতালব্ধ ধীশক্তি বা বুদ্ধিকে প্রয়োগ করে। (The reader user her Understanding of her own experience cf life)
পড়ার সময় বিভিন্ন প্যারা ও অনুচ্ছেদের মধ্যে সম্পর্ক এবং সম্পূর্ণ বিষয়টির অর্থ অনুধাবন করতে সে তার
বুদ্ধিকে ব্যবহার করে।
পড়াকে হৃদয়ঙ্গম করার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হচ্ছে ধারণার সৃষ্টি (Concept building)। অর্থাৎ কোনো বিষয়ে পড়ার সফলতার পূর্বশর্ত হচ্ছে ওই বিষয় সম্পর্কে একটি ধারণার উন্নয়ন।
২. স্মৃতি (Memory)
স্মরণশক্তি একজন পাঠককে বিভিন্নভাবে সহায়তা করে থাকে। এর সাহায্যে অতীত অভিজ্ঞতা হুবহু মনে করতে পারে। কোনোকিছু পড়ে তার ব্যাখ্যা দিতে বা কোনো চিহ্নের অর্থ প্রদান করতে পাঠক তার বুদ্ধি ও স্মৃতিশক্তি ব্যবহার করে থাকে। স্মৃতির উত্তম সংরক্ষণাগার হিসেবে ব্যবহৃত হয় মেধা বা ব্রেইন (Brain)। মনীষী জে, এফ, নিস্বেট-এর মতে,
‘‘প্রতিভাবানদের জন্য স্মৃতিশক্তি হচ্ছে এক অমূল্য সম্পদ।’’
৩. এককেন্দ্রাভিমুখী চিন্তা (Convergent thinking )
যখন কোনো তথ্যকে বিবেচনা করার সময় যুক্তি বা সঠিকতা যাচাই করা হয় অথবা এর অর্থগত বা সাধারণীকরণের বিষয়টি বিবেচনা করা হয়, তখন এরূপ চিন্তাকে এককেন্দ্রামুখী চিন্তা বলে।
৪. বহুমুখী চিন্তা (Divergent thinking)
কোনো বিষয় বা তথ্য সম্পর্কে যখন এককেন্দ্রীক চিন্তা না করে এর বহুবিধ প্রয়োগ, অর্থ বিবেচনা করা হয় তাকে বহুমুখী চিন্তা বলা হয়। উদাহরন - ধরা যাক, হেলাল এককেন্দ্রীক চিন্তাশীল ব্যক্তি। খবরের কাগজ কেন ব্যবহার করা হয়? তাকে এরূপ প্রশ্ন করা হলে সে বলতে পারে পড়ার জন্য ব্যবহার করা হয়। তাকে আরও ব্যবহারের কথা জিজ্ঞেস করলে সে বিরক্ত হতে পারে। কারণ সে এককেন্দ্রীক চিন্তা করে।
অপরপক্ষে নেহাল বহুমুখী চিন্তাশীল ব্যক্তি (Divergent thinking) সে খবরের কাগজের একাধিক ব্যবহারের কথা বলতে বিরক্ত হবে না।
৫. মূল্যায়ন (Evalution)
জ্ঞানের পঞ্চম প্রক্রিয়া হচ্ছে মূল্যায়ন। এটা পঠিত বিষয়ের মূল্য (Value) যথার্থতা (authenticity) সামঞ্জস্য বা দৃঢ়তা (Consistency) এবং অন্যান্য যুক্তিযুক্ত উপাদান সম্পর্কে বিচার বিশ্লেষণ করতে পাঠককে সহায়তা করে।
সর্বশেষ এটা সবার মগজে রাখতে হবে ভালো ছাত্র হতে চাইলে পরিশ্রমের কোন বিকল্প নেই। আপনি যত শর্টকাট খুঁজেন না কেন পরিশ্রম ছাড়া সফলতার মুখ দেখতে পারবেন না। ফলে পরিশ্রম না করে সফলতা খোঁজা স্রেফ সময় নষ্ট ছাড়া কিছুই নয়। তাই সব ভালো ছাত্রই পরিশ্রমী হয় যার দরুন সফলতার চূড়ায় তারা আরোহণ করে নির্ভয়ে।