মৌসুমী বৃষ্টিপাত ও আবহাওয়া পূর্বাভাস কীভাবে এলো?
বাংলাদেশের আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা মৌসুমী বৃষ্টিপাত এর বার্তা তথা পূর্বাভাস নিয়ে মাঝেমধ্যে বেশ গোলকধাঁধায় পড়েন। বর্ষা সত্যি করে আসবার অনেক আগেই শুরু হয়ে যায় মৌসুমী বৃষ্টিপাত এর মতো অঝোর ধারায় বৃষ্টি। আর বর্ষা যখন আসবার কথা তার বেশ কিছুদিন পর শুরু হয় আসল মৌসুমী বৃষ্টিপাত। আবহাওয়া বিশেষজ্ঞদের পূর্বাভাস আর প্রকৃত আবহাওয়ার মধ্যে তাই বারবার ঘটতে থাকে গরমিল।
আবহাওয়ার খামখেয়ালী চরিত্র এমন কিছু নতুন জিনিস নয়। এমনি খেয়ালীপনা তার চিরকালই ছিল; সাম্প্রতিককালে কিছুটা প্রাকৃতিক কারণে কিছুটা পরিবেশের ওপর মানুষের নানা ক্রিয়াকর্মের প্রভাবে হয়তো তা কিছু পরিমাণে বেড়েছে। আর গত কয়েক দশকে আবহাওয়ার বিপুল অগ্রগতি সত্ত্বেও এখনও দুনিয়ার সব দেশেই আবহাওয়ার নিখুঁত পূর্বাভাস দেওয়ার সমস্যা রীতিমতো জটিলই রয়ে গিয়েছে।
আবহাওয়াবিদ্যার চর্চা ব্যাপকভাবে চলছে প্রায় শ-খানেক বছর হল। দুনিয়াজোড়া সূর্যতাপের ওঠানামা, দেশে দেশে হাওয়ার আনাগোনা, সমুদ্রের বুকের বিশাল সব স্রোতের সাথে জলবায়ুর সম্পর্ক, নানা ঋতুতে বৃষ্টি-বাদলার বৈচিত্র্য - এসব সম্বন্ধে বিজ্ঞানীরা আজ অনেক কথা জেনেছেন। জেনে সমগ্র পৃথিবী আর তার নানা এলাকার আবহাওয়ার স্বল্পকালীন আর দীর্ঘকালীন পূর্বাভাস দেবার পথে অনেক দূর এগিয়েছেন তাঁরা। কিন্তু দক্ষিণ আর পূর্ব এশিয়ার যে এলাকাটাকে বলা হয় মৌসুমী অঞ্চল তার জলবায়ুর চরিত্র নিয়ে ব্যাপক আকারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয়েছে খুব সাম্প্রতিককালে।
বাংলাদেশের চাষবাস অর্থনীতি প্রায় সম্পূর্ণ নির্ভর করে মৌসুমী বৃষ্টিপাত এর ওপর। আর এই মৌসুমী বৃষ্টিপাত এর প্রভাব পড়ে আফ্রিকার পশ্চিম উপকূল থেকে উত্তর-পূর্ব এশিয়ায় চীন পর্যন্ত বিশাল অঞ্চলে। এই এলাকায় বাস দুনিয়ার প্রায় অর্ধেক লোকের। এখানে যদি নিয়মিত বর্ষা হয় তাহলে ফসলের প্রাচুর্য ঘটবে - মানুষের মুখে ফুটবে হাসি। কিন্তু প্রায়ই বর্ষণ আসে অনিয়মিত। কখনো প্রচণ্ড বর্ষায় ভেসে যায় খেতখামার, বাড়িঘর; আবার কখনো অনাবৃষ্টিতে পুড়ে যায় খেতের ফসল। মৌসুমী বৃষ্টিপাত এর খেয়ালী চরিত্রের হদিস পাওয়া শক্ত।
এ দেশের মানুষ এই মৌসুমী বৃষ্টিপাত এর পূর্বাভাস বুঝতে চেষ্টা করছে বহু হাজার বছর ধরে। ভারতীয় বৈদিক রচনায় বারবার এসেছে মেঘ, মৌসুমী বৃষ্টিপাত, বায়ু, বজ্রের কথা। মহাভারতে বর্ষার আগমনের রয়েছে বিস্তারিত বর্ণনা। মহাকবি কালিদাস ‘মেঘদূত’ কাব্যে বর্ষার মেঘের বিসর্পিল যাত্রাপথের যে বিবরণ দিয়েছেন তা নিতান্ত কবি কল্পনাপ্রসূত না হওয়াই সম্ভব।
প্রাচীন গ্রীক পণ্ডিতরা আবহাওয়া নিয়ে অনেক চিন্তাভাবনা করেছিলেন। অ্যারিস্টটল তাঁর পর্যবেক্ষণ সুসংবদ্ধ করে আবহাওয়া তত্ত্বের ওপর একটি গ্রন্থ রচনা করেন খ্রীস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে। এই সময়ে আলেকজান্ডারের নেতৃত্বে গ্রীকরা এসেছিলেন ভারত অভিযানে। তখনই এ দেশের জলবায়ুর সাথে তাঁদের পরিচয় ঘটে। হিপালাস নামে সেকালের এক গ্রীক পণ্ডিত বর্ণনা করেছেন ভারত মহাসাগরে মৌসুমী বৃষ্টিপাত ও বায়ু প্রবাহের কথা; আর বলেছেন সমুদ্র থেকে স্থলের দিকে যখন এই বায়ু বয় তখনই গ্রীস থেকে নৌপথে ভারতে যাত্রার উপযুক্ত সময়।
গ্রীকদের সংস্পর্শে এসে ভারতীয় পণ্ডিতদের মধ্যে আবহাওয়া সম্পর্কে চর্চা অগ্রসর হয়েছিল। খ্রিষ্টীয় যষ্ঠ শতকে জ্যোতির্বিদ বরাহমিহির তাঁর ‘বৃহৎ-সংহিতা’ গ্রন্থে নানা লক্ষণ দেখে বর্ষা ঋতুর পূর্বাভাস দেবার পদ্ধতি বর্ণনা করেছেন। চান্দ্র মাস অনুসারে তাঁর উল্লিখিত পূর্বাভাস লক্ষণের মধ্যে রয়েছে বায়ুপ্রবাহ, আকাশের বর্ণ, সূর্য ও চাঁদের স্বাভাবিক প্রকৃতি, গ্রহদের অবস্থান ইত্যাদি। স্বাভাবিক অবস্থায় কোন কোন মাসে কতদিন বৃষ্টি হবে তার কথাও উল্লেখ করেছেন তিনি। আজকের ইংরেজী মাস অনুযায়ী এই হিসেবে দাঁড়ায় : মে মাসে ৮ দিন; জুন মাসে ৬ দিন; জুলাই মাসে ১৭ দিন; আগস্ট মাসে ২৪ দিন; সেপ্টেম্বর মাসে ২০ দিন; অক্টোবর মাসে তিন দিন। বলাবাহুল্য, এই হিসেবের পেছনে রয়েছে দীর্ঘকালের পর্যবেক্ষণের ফল।
অষ্টম শতকে আরব বণিকরা নৌপথে ব্যাপকভাবে ভারতে আসতে আরম্ভ করেন। ভারত মহাসাগর দিয়ে সমুদ্রযাত্রার পথে বছরের বিভিন্ন সময়ে বায়ুর গতি পরিবর্তন সহজেই তাঁদের চোখে পড়ে এবং এ বিষয় নিয়ে তাঁরা চর্চা করেন। ঋতুর আরবী প্রতিশব্দ ‘মৌসিম’ থেকে মৌসুমী বায়ুপ্রবাহের নামকরণ এভাবেই ঘটে। আরবরা সাধারণত গ্রীষ্মকালীন মৌসুমীর প্রবল বায়ুপ্রবাহ এড়িয়ে অপেক্ষাকৃত মৃদু শীতকালীন মৌসুমী বায়ুপ্রবাহের সময় উপমহাদেশে বাণিজ্যে আসতেন। দুর্ভাগ্যক্রমে মধ্যযুগে এদেশে সাধারণভাবে পূর্বাভাস এর ক্ষেত্রে বা মৌসুমী বায়ু সম্পর্কে কোন উল্লেখযোগ্য বৈজ্ঞানিক গবেষণার পরিচয় পাওয়া যায় না।
পঞ্চদশ শতকের শেষে আরম্ভ হয় সমুদ্রপথে ইউরোপীয়দের নানা দেশে অভিযান। কলম্বাস পৌঁছলেন আমেরিকায়; ভাসকো দা-গামা ভারতে। রেনেসাঁর প্রভাবে বিজ্ঞানেরও অগ্রগতি শুরু হয়। ষোড়শ শতকের শেষে (১৫৯৩) ইতালিতে গ্যালিলিও উদ্ভাবন করলেন তাপমান যন্ত্র; কিছুদিনের মধ্যে (১৬৪৮) টরিসেলি উদ্ভাবন করলেন বায়ুচাপমান যন্ত্র। এসব আবিষ্কার সমুদ্রযাত্রার সহায়ক হল; বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চর্চা চলতে লাগল ব্যাপকভাবে। তখন থেকেই বৃষ্টির পূর্বাভাস দেওয়া নিয়ে শুরু হয় গবেষণা।
সতের দশকের শেষে ব্রিটিশ জ্যোতির্বিদ এডমন্ডহ্যালি তৈরি করলেন বিভিন্ন সমুদ্রের প্রথম বায়ুপ্রবাহ মানচিত্র। মৌসুমী বায়ুর কারণ যে গ্রীষ্মকালে এশিয়ার স্থলভাগ অতিমাত্রায় উত্তপ্ত হয়ে ওঠা আর শীতকালে ভারত মহাসাগরের জলভাগ বেশি উত্তপ্ত হয়ে ওঠা-তাও ব্যাখ্যা করলেন তিনি। আরেকজন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী হ্যাডলী ১৭৩৫ সালে প্রস্তাব করলেন সমগ্র পৃথিবীর ওপর ‘সাধারণ বায়ুপ্রবাহের’ তত্ত্ব।
এই তত্ত্ব অনুসারে পৃথিবীতে বায়ুপ্রবাহের মূল কারণ হল বিষুব অঞ্চল বেশি সূর্যকিরণ পেয়ে তেতে ওঠা আর মেরু অঞ্চল সূর্যতাপের অভাবে শীতল হয়ে পড়া। পৃথিবীতে যদি বায়ুপ্রবাহ বা সমুদ্রপ্রবাহ না থাকত তাহলে বিষুব অঞ্চল হয়ে উঠত তাপদগ্ধ আর ২৪ ঘণ্টা রাতের অন্ধকারে মেরু অঞ্চলের তাপমাত্রা নেমে যেত পরম শূন্যের (সেলসিয়াস মাপে শূন্যের নিচে ২৭৩ ডিগ্রি) কাছাকাছি। কিন্তু বায়ুপ্রবাহ আর সমুদ্রপ্রবাহ তাপশক্তি বয়ে নেয় বলেই পৃথিবীর অঞ্চলের মধ্যে উষ্ণতার এমন প্রবল পার্থক্য ঘটতে পারে না।
হ্যাডলীর তত্ত্ব অনুসারে বিষুব অঞ্চলের কাছাকাছি বায়ু তেতে ওঠায় দুই গোলার্ধেই বায়ু ছোটে বিষুব রেখার দিকে। এই উষ্ণ আয়ন বায়ু সমুদ্রের বাষ্প বয়ে নিয়ে হালকা হয়ে উঠতে থাকে ওপর দিকে-আর সৃষ্টি করে প্রচুর মেঘ। জলীয় বাষ্প বয়ে নেয়া এই বায়ু ছড়িয়ে পড়তে থাকে উত্তর-দক্ষিণে দুই মেরু অঞ্চলের দিকে, আর তার সাথে বয়ে নেয় প্রচুর পরিমাণে তেজ।
আজকের বিজ্ঞানীরা হ্যাডলীর প্রস্তাবিত এই চিত্রকে অতি সরল বলে মনে করেন। কেননা মেরু অঞ্চল আর বিষুব অঞ্চলের মধ্যে বায়ুপ্রবাহের রয়েছে আরো নানা বৈচিত্র্য, অসংখ্য পাকচক্র। তবে এই চিত্র থেকে সমগ্র পৃথিবীর বায়ুপ্রবাহে বিষুব অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ অবদান সহজে উপলব্ধি করা যায়।
বিষুব অঞ্চল সমগ্র পৃথিবীর বায়ু সঞ্চালনে যে শক্তি সঞ্চার করে তা-ই কখনো কখনো গ্রীষ্মকালীন মৌসুমীর শুরুতে বা শেষে রূপ নেয় প্রচণ্ড সাইক্লোন বা ঘূর্ণিঝড়ের। এই ঘূর্ণিঝড়ের রহস্য আর মৌসুমী বৃষ্টিপাত এর রহস্য মূলত একই সুতোয় বাঁধা। বিষুবীয় অঞ্চলের আবহাওয়ার চরিত্র পুরোপুরি উদঘাটিত না হলে এ দু’টির কোনটিই ভালমতো বুঝতে পারা যাবে না। গত একশ’ বছরে পাশ্চাত্যের বিজ্ঞানীরা ক্রান্তীয় অঞ্চলের জলবায়ু ও পূর্বাভাস সম্পর্কে যে পরিমাণ গবেষণা করেছেন সে তুলনায় বিষুবীয় অঞ্চলের জলবায়ু নিয়ে গবেষণা হয়নি।
আমাদের দেশে গ্রীষ্মকালের দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ুই সৃষ্টি করে বর্ষা ঋতু। আজ আমরা জানি, গ্রীষ্মকালে প্রখর সূর্যতাপে ভারতের পশ্চিমাঞ্চলে (কখনো তিব্বতের মালভূমিতে) সৃষ্টি হয় ব্যাপক লঘুচাপ। তার প্রভাবে দক্ষিণ গোলার্ধের দক্ষিণ-পূর্ব আয়নবায়ু বিষুব রেখা অতিক্রম করে ডান পাশে বেঁকে পরিণত হয় দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ুতে। এই উষ্ণ ভেজা বায়ু বর্মার পর্বতমালা, আসামের পাহাড়, উত্তরে বিশাল হিমালয়, পশ্চিমে আরাবল্লী আর পশ্চিমঘাট পর্বতের আবদ্ধ এলাকায় বাধা পেয়ে উঠতে থাকে উঁচুতে। এর ফলেই বর্মা, বাংলাদেশ আর ভারতে প্রচুর মৌসুমী বৃষ্টিপাত ঘটে।
সাধারণত বর্মায় বর্ষাঋতু আরম্ভ হয় মে মাসের মাঝামাঝি, বাংলাদেশে এবং দক্ষিণ ভারতে জুনের শুরুতে, মধ্যভারতে জুলাই মাসে। উপমহাদেশের পশ্চিম অংশে বর্ষা ঋতু শেষ হয় সেপ্টেম্বরের শুরুতে, বাংলাদেশে অক্টোবরের প্রারম্ভে। বর্ষাকালে তা বলে বৃষ্টিপাত নিরবচ্ছিন্নভাবে ঘটে না। কয়েকদিন বৃষ্টির পর পর দেখা দেয় বিরতি। এর সাথে বঙ্গোপসাগরের লঘুচাপ সৃষ্টির রয়েছে গভীর সম্পর্ক। বর্ষাকালে সাধারণত প্রতি মাসে দু’তিনটি করে লঘুচাপ সৃষ্টি করে। এসব লঘুচাপের উৎপত্তি সাধারণত ঘটে অনেক পূর্বে কোথাও—কখনো কখনো পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের—সেখানে থেকে ক্রমে ক্রমে এরা সরে আসে বঙ্গোপসাগরে।
বাংলাদেশে মৌসুমী বৃষ্টিপাত সাধারণত ছ’বছর আর এগারো বছর পর পর ওঠা-নামা করে; মনে হয় এর সাথে সৌরকলঙ্কের ওঠা-নামার যোগ আছে। কিন্তু কোন বছর মৌসুমী বৃষ্টিপাত কম বা বেশি হবে, কখন শুরু হবে কখন থামবে, কেমন হবে তার তীব্রতার ওঠা-নামা—এসব খবর আগে থেকে জানতে পেলে কৃষি পরিকল্পনা হতে পারে অনেক সহজ। কিন্তু এসব তথ্য জানতে হলে পৃথিবীর বিশাল এলাকার তাপ সমাবেশ, সমুদ্রপ্রবাহ, বায়ুপ্রবাহ ইত্যাদি অসংখ্য বিষয়ে জানতে হবে প্রচুর তথ্য। সে তথ্য সংগ্রহের ব্যবস্থা যেমন চাই, তেমনি চাই তার দ্রুত বিশ্লেষণের আয়োজন। ষাটের দশকের শুরুতে আবহাওয়ার উপগ্রহ উৎক্ষেপণের মাধ্যমে মহাশূন্য থেকে পৃথিবীর আবহাওয়ার তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে বিপুল অগ্রগতি ঘটেছে; তার সাথে যোগ হয়েছে ত্বরিৎগতিতে বিপুল তথ্য বিশ্লেষণের জন্য ইলেকট্রনিক কম্পিউটার বা যন্ত্রগণক।
ভারত মহাসাগর এলাকা সম্বন্ধে বড় আকারে তথ্য সংগ্রহের উদ্যোগ নেওয়া হয় ১৯৬৩ সালে। আন্তর্জাতিক ভারত মহাসাগর অভিযানে অংশগ্রহণ করলেন বহু দেশের বিজ্ঞানী। জটিল যন্ত্রসজ্জিত জাহাজ ও বিমান থেকে সংগ্রহ করা হল নানান তথ্য।
ইতিমধ্যে বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা ব্যাপক আকারে সারা পৃথিবীর আবহাওয়া-সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহের জন্য ‘গার্প’ (গ্লোবাল অ্যাটমসফেরিক রিসার্চ প্রোগ্রাম) বা বিশ্বব্যাপী বায়ুমণ্ডল গবেষণা কর্মসূচী গ্রহণ করেছেন। তার অংশ হিসেবে ১৯৭৯ সালে এক বছর ধরে অনুষ্ঠিত হল ‘মনেক্স’ বা মনসুন এক্সপেরিমেন্ট। এই কর্মসূচীতে বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি-সজ্জিত পাঁচটি জাহাজ দিল সোভিয়েত ইউনিয়ন, চারটি ভারত, একটি ফ্রান্স; যন্ত্রসজ্জিত বিমান পাওয়া গেল তিনটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে, একটি ভারত থেকে।
আফ্রিকার উপকূল থেকে বর্মার উপকূল পর্যন্ত সমগ্র এলাকায় সমুদ্র স্রোত, বিভিন্ন গভীরতায় পানির উষ্ণতা, বিভিন্ন উচ্চতায় বায়ুর উষ্ণতা, বায়ুবেগ, সূর্যকিরণের পরিমাণ, আর্দ্রতা ইত্যাদি বহু বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার একটি ভূস্থির আবহাওয়া উপগ্রহ সরিয়ে এনে স্থাপন করল ৬০ ডিগ্রি পূর্ব অক্ষাংশে বিষুব রেখার ওপরে। এর তোলা আবহাওয়ার প্রতিচ্ছবি পাওয়া যেতে লাগল বোম্বাইতে। জাপানের অন্য একটি ভূস্থির উপগ্রহের তোলা ছবি পাওয়ার ব্যবস্থা করা হল ঢাকায়। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে এসব তথ্য বিনিময়ের আয়োজন করা হল।
মনেক্স কর্মসূচী থেকে জানা গেল নানা তথ্য। দেখা গেল এই উপমহাদেশে গ্রীষ্মকালীন মৌসুমী বায়ুর সূত্রপাত ঘটে আফ্রিকার পশ্চিম উপকূল থেকে; আর মধ্য ভারতে বৃষ্টিপাত শুরু হবার সপ্তাহখানেক আগে আরব সাগরের পানি আর বায়ুতে শক্তি সমাবেশ বেড়ে যায় উল্লেখযোগ্যভাবে। আরো লক্ষ্য করা গেল বায়ুবেগ বৃদ্ধির পর আরব সাগরের পানির উষ্ণতা কমে আসে। এই গবেষণার বিপুল পরিমাণ তথ্য নানা দেশের বিজ্ঞানীরা এখনো বিশ্লেষণ করে চলেছেন।
আবহাওয়ার সকল প্রকাশই বিশ্বব্যাপী অসংখ্য ঘটনা পরম্পরার সাথে যুক্ত; আর এ সকল ঘটনা বা প্রভাব অধিকাংশই স্থান নয়, প্রতি মুহূর্তে পরিবর্তনশীল। এজন্যই আবহাওয়ার গবেষণার আজ আবহবিদের সাথে যোগ দিচ্ছেন পদার্থবিদ, গণিতবিদ, ভূ-পদার্থবিদ, জলতত্ত্ববিদ প্রভৃতি নানা বিভাগের বিজ্ঞানীরা। আর তাঁদের সম্মিলিত গবেষণার মাধ্যমে উদঘাটন করতে চেষ্টা করছেন বিষুব অঞ্চলের প্রাকৃতিক শক্তি সমাবেশের চরিত্র, এই অঞ্চলে আবহাওয়া আর মৌসুমী বৃষ্টিপাত এর ওপর তার প্রভাব। বিজ্ঞানীরা নানান প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার সৃষ্টি করছেন বিভিন্ন ধরনের গাণিতিক মডেল; কম্পিউটারের মাধ্যমে অসংখ্য তথ্য বিশ্লেষণ করে পাওয়া যাচ্ছে সেসব সমস্যার সমাধান।
মৌসুমী বৃষ্টিপাত এমনকি বজ্রপাতের পূর্বাভাস আজো নানা অনিশ্চয়তায় আচ্ছন্ন। নানা দেশের বিজ্ঞানীদের সমন্বিত গবেষণার ফলে হয়তো এই পূর্বাভাস - এ যুক্ত হবে আরো বেশি নিশ্চয়তা; আর তা আমাদের সাহায্য করবে অতিবৃষ্টি, বন্যা বা খরাকে আরো সাফল্যের সাথে মোকাবিলা করতে।