হ্যালির ধূমকেতু সম্পর্কে মজার গল্প
হ্যালির ধূমকেতু সম্পর্কে আজকের এই লেখাটি। পৃথিবীর আকাশে সচরাচর যেসব জ্যোতিষ্ক দেখা যায় সেগুলো আমাদের অতি চেনা - যেমন : সূর্য, চাঁদ আর তারা। কিছু তারার মতো বস্তু আছে যেগুলো আকাশে মনে হয় কিছুটা এলোমেলো পথে ঘোরে আর অনেকটা স্থির আলো দেয়। বহু হাজার বছর আগেই মানুষ এদের নাম দিয়েছিল গ্রহ। আজ থেকে মাত্র চার-পাঁচশ’ বছর আগে মানুষ বুঝতে পেরেছে এসব গ্রহ সৌরজগতের অংশ অর্থাৎ পৃথিবীর মতো এরাও সূর্যের চারপাশে ঘোরে।
রাতের আকাশে কখনো কখনো হঠাৎ একটি দু’টি তারা ছুটে যায় বলে মনে হয়। এদের বলা হয় উল্কা। আজ আমরা জানি যে, এসব ছুটন্ত তারা আসলে মোটেই তারা নয় - ছোটখাটো ধুলো-বালি বা পাথরের টুকরো। এরা ছড়ানো আছে সূর্যের চারপাশে মহাশূন্যে। পৃথিবীর চলার পথে পড়লে তার আকর্ষণের টানে এরা বায়ু মণ্ডলের ভেতর এসে পড়ে। বায়ুমণ্ডলের ঘষায় বেশির ভাগই জ্বলে ছাই হয়ে যায়; কখনো-কখনো বড়সড় পাথরের খণ্ড পৃথিবীর ওপর এসে পড়ে। অতি কদাচিৎ কিছু বস্তু দেখা দেয় আকাশে, এদের বোঝা অত সহজ হয় না। এরা হঠাৎ দেখা দেয় - কখনো তারার মতো, কখনো বা খোলা তলোয়ারের মতো; আকাশে কিছুদিন ঝুলে থেকে তারপর আবার মিলিয়ে যায়। অনেকটা ধোঁয়ার মতো দেখায় বলে এদের নাম দেয়া হয় ধূমকেতু। কিন্তু এরা কোথা থেকে আসে, কোথায় যায় সেটা বুঝতে মানুষকে অনেক বেগ পেতে হয়েছে। তাই বহুকাল ধরে আকাশে এটি দেখা দিলে মানুষ ভয় পেয়েছে খুব।
আকাশে এমনি যত ধূমকেতু এযাবৎ দেখা গিয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বড় আর নাটকীয় হলো হ্যালির ধূমকেতু। বিখ্যাত বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটনের বন্ধু এডমণ্ড হ্যালি ১৬৮২ সালে এটি দেখে তার গতিপথ হিসেব করে বলেন, এটা অতি লম্বা ডিমের মতো উপবৃত্তাকার পথে সূর্যের চারপাশে ঘোরে আর ৭৫-৭৬ বছর পর পর আসে সূর্যের সবচেয়ে কাছে। হ্যালির ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী এটি দেখা দেয় ১৭৫৮ সালে। সেই থেকে এর নাম দেয়া হয় হ্যালির ধূমকেতু। হিসেব করে দেখা যায় চীনদেশে খ্রীষ্টপূর্ব ২৪০ সালে চীনা জ্যোতির্বিদরা যে বড় একটি বস্তু দেখেন আকাশে, সেটিও আসলে ছিল এই হ্যালির ধূমকেতু।
একাদশ শতকে তৈরি বিলেতের একটি নকশীকাঁথায় ১০৬৬ সালের এপ্রিল মাসে দেখা একটি হ্যালির ধূমকেতুর ছবি আছে। ঐ সময়ে বিলেতের রাজা ছিলেন হ্যারল্ড। তাঁর সাথে যুদ্ধ বেধেছিল ফ্রান্সের নরম্যান্ডি অঞ্চলের ডিউক উইলিয়মের। আকাশে ধূমকেতু দেখেই হ্যারল্ডের মনে হয়েছিল ভাগ্য তাঁর ওপর সুপ্রসন্ন নয়। হেস্টিংসের যুদ্ধে হ্যারল্ড সত্যি সত্যি হেরে গেলেন উইলিয়মের সৈন্যদের কাছে। বিজয়ী উইলিয়ম দখল করলেন ইংল্যান্ডের সিংহাসন। বিলেতের ইতিহাসে নতুন যুগের পত্তন হল। ফরাসি হয়ে দাঁড়াল বিলেতের রাজভাষা, ইংরেজি রইল শুধু চাষা-ভূষা সাধারণ মানুষের ভাষা হয়ে।
তারপর এমনি একটা ব্যাপার ঘটে মেক্সিকোতে। ১৫১৭ সালে সে দেশের আকাশে দেখা দেয় বিশাল এক ধূমকেতু। সেখানে তখন আজটেক জাতির সম্রাট মকটেজুমার রাজত্ব, এটি দেখে তাঁর মনে হল দেবতারা তাঁর ওপর বিরূপ। এমনি সময়ে হারনান কর্টেজের নেতৃত্বে একদল স্পেনীয় আক্রমণ করল মেক্সিকো। ধূমকেতু দেখে মকটেজুমা আগে থেকেই ভীত হয়ে ছিলেন। তিনি সহজেই রণে ভঙ্গ দিলেন - মেক্সিকো চলে গেল স্পেনের দখলে। এমনি এক দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায় সেকালের আজটেকদের আঁকা ছবিতে। আজ আমরা হিসেব করে বলতে পারি, এটিও ছিল হ্যালির ধূমকেতু। কিন্তু এটা যে কী জিনিস বা কী দিয়ে তৈরি, তা সেকালের লোকের পক্ষে বোঝা ছিল শক্ত। ১৫৭৮ সালে জার্মানিতে ইহুদি ম্যাগডিবুর্গের বিশপ ধূমকেতুর স্বরূপ ব্যাখ্যা করে একটি বই লেখেন। তাতে তিনি লিখলেন, ধূমকেতু হল “মানুষের পাপের গাঢ় ধোঁয়া - প্রতিদিন, প্রতিঘণ্টা, প্রতি মুহূর্তে ঈশ্বরের মুখের সামনে আকাশের পানে উঠছে বিভীষিকা আর পুতিগন্ধময় এই ধোঁয়া; ক্রমে ক্রমে গাঢ় হয় এই ধোঁয়াই সৃষ্টি করে কোঁকড়ানো আর বেণীবদ্ধ কেশদামযুক্ত ধূমকেতু - আর অবশেষে তা জ্বলে ওঠে স্বর্গীয় পরম বিচারকের উত্তপ্ত, তীব্র রোষবহ্নিতে।” এই বই পড়ে কেউ কেউ বলতে লাগল, ধূমকেতু যদি পাপের ধোঁয়া হবে তাহলে আকাশে সারাক্ষণই এটি ঝলসাত, কিন্তু কই, তা তো দেখা যায় না - এটা দেখা দেয় ক্বচিৎ কদাচিৎ।
ষোড়শ আর সপ্তদশ শতকের জ্যোতির্বিদরা - তাইকো ব্রাহে, কেপলার, নিউটন - এরা ধূমকেতু নিয়ে অনেক চিন্তাভাবনা করেছিলেন। নিউটন বললেন, ধূমকেতু নিশ্চয়ই পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ভেতর আসে না, কেননা তাহলে বায়ুমণ্ডলের ঘষায় তারা পুড়ে ছাই হয়ে যেত। এদের দেখতে পাওয়া যায় সূর্যের প্রতিফলিত আলোতে। অতএব, এরা তারার জগতের বাসিন্দাও নয়, কেননা তাহলে তাদের পৃথিবী থেকে এমন আলোকিত দেখাত না। তিনি বললেন, আসলে ধুমকেতু সৌরজগতের অংশ; এরা গ্রহদের মতোই ঘোরে সূর্যের চারপাশে, তবে তাদের ঘোরাপথ অতি লম্বা উপবৃত্ত। এ থেকেই ১৭০৫ সালে এডমন্ড হ্যালি হিসেব করে দেখলেন ১৫৩১, ১৬০৭ আর ১৬৮২ সালে যেসব ধূমকেতু দেখা গিয়েছিল সে আসলে ঘুরে ঘুরে আসা একই ধূমকেতু আর তাকে আবার দেখা যাবে ১৭৫৮ সালে। হ্যালি মারা যান ১৭৪২ সালে, তাই তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী যে ফলেছিল তা তিনি নিজে দেখে যেতে পারেননি।
আজকের বিজ্ঞানীরা মনে করেন ধূমকেতু হল মূলত জমাটবাঁধা পানির বরফ - তার সাথে মেশানো কিছু মিথেন, অ্যামোনিয়া আর ধুলোবালি। অধিকাংশ বেলাতেই এই পিণ্ডটা হয়তো মোটামুটি দু’এক কিলোমিটার ব্যাসের। হ্যালির এটি বেশ বড়সড়, কাজেই এর বস্তুপিণ্ড হতে পারে পাঁচ থেকে দশ কিলোমিটার চওড়া।
বিজ্ঞানীরা এ যাবৎ বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীর আকাশে এমনি ধূমকেতুর হদিস পেয়েছেন প্রায় হাজারখানেক। তার মধ্যে বেশির ভাগেরই সূর্যের চারপাশে একবার ঘুরে আসতে লাগে দু’শ বছরের ওপর - যেমন ১৯৭৩ সালে কোহুতেক নামে যে ধূমকেতু দেখা গিয়েছিল তার লাগে ৭৫,০০০ বছর। মাত্র শ-দেড়েক এটার কথা জানা গিয়েছে যেগুলো দু’শ বছরের কম সময়ে পৃথিবীর কাছে ঘুরে ঘুরে আসে। এর মধ্যে ‘এনকে’ নামে একটি হ্যালির ধূমকেতু দেখা যায় মাত্র ৩.৩ বছর পর পর।
ধূমকেতু তার ঘোরাপথের বেশির ভাগ সময় অতি লম্বা উপবৃত্তকার পথে কাটায় সূর্য থেকে অনেক দূরে। বহু বছর পর পর যখন এরা সূর্যের কাছাকাছি এলাকায় আসে - অর্থাৎ মঙ্গল আর বৃহস্পতির কক্ষপথের মাঝে এলে - সূর্যের তাপে ধূমকেতুর গা থেকে কিছু বস্তু বাষ্প হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। সুর্যের আলো এই ছড়িয়ে পড়া গ্যাসীয় বস্তু থেকে ঠিকরে আসে, তাতেই সৃষ্টি হয় ধূমকেতুর উজ্জ্বল মুণ্ড, কখনো সৃষ্টি হয় অতি লম্বা লেজ। সূর্য কিরণের চাপে এই গ্যাসের লেজটা ছড়ায় সুর্যের বিপরীত দিকে; এটি সূর্যের যত কাছে আসে তত লম্বা হয় এই লেজ। আর তাই যখন ধূমকেতু তার লম্বা কক্ষপথে সূর্যের দিকে আসতে থাকে তখন লেজটা থাকে পেছন দিকে, আর সূর্যকে ঘিরে যখন দূরে চলে যায় তখন লেজ থাকে সামনের দিকে। আকাশে এমনি লেজওলা ধূমকেতু দেখে কেউ ভাবে একটা জলন্ত ঝাঁটা, কেউ দেখে ঝুলন্ত তলোয়ার, আবার কেউ দেখে কোন চুলের গোছা।
হ্যালির ধূমকেতু শেষবার পৃথিবী থেকে দেখা গিয়েছিল ১৯১০ সালের মে মাসে। আবার পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে আসছে ১১ এপ্রিল ১৯৮৬ তারিখে। অবশ্য তার বেশ কিছুদিন আগে থেকেই একে ছোটখাটো দূরবীন দিয়ে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। এবার সবচেয়ে ভালভাবে দেখা যাচ্ছে দক্ষিণ গোলার্ধে।
হ্যালির ধূমকেতু আসার আগে থেকেই অনেকে জল্পনা-কল্পনা করছে - এর ফলে পৃথিবীর ওপর কোন অমঙ্গলের আশঙ্কা আছে কি না। ১৯১০ সালে যখন এটি দেখা দিয়েছিল তখন তার প্রায় আট কোটি কিলোমিটার লম্বা লেজ পৃথিবীর গা ছুঁয়ে যায়। তার আগে অনেকে এর ফলে পৃথিবীতে নানা বিপর্যয় ঘটবে বলে ভয় দেখাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল এটির লেজ পৃথিবীতে ছুঁয়ে চলে গেল, কিন্তু সে রকম কিছুই ঘটল না।
এবার হ্যালির ধূমকেতু এলে পৃথিবীতে বিপর্যয় ঘটবার আশঙ্কা নিয়ে যতটা না শোরগোল হচ্ছে, তার চেয়ে বরং বেশি শোনা যাচ্ছে রকেটযান পাঠিয়ে এটার সম্বন্ধে বিজ্ঞানীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা। গত ত্রিশ বছরে মানুষ পৃথিবীর আকর্ষণ কাটিয়ে-ওঠা রকেটযান আর নভোযান মহাকাশের নানা রহস্য ভেদ করতে শুরু করেছে। এবার বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতিসহ বেশ ক’টি রকেটযান পাঠানো হয়েছে এটিকে লক্ষ্য করে। এটি যখন পৃথিবীর কাছাকাছি আসবে তখন রকেটযানও গিয়ে পৌঁছবে তার কাছে; তারপর সেখানকার গ্যাসকণার গঠন, ঘনত্ব, তেজ, চৌম্বকক্ষেত্র ইত্যাদি সম্বন্ধে খবরা-খবর সংগ্রহ করে পৃথিবীতে পাঠাবে। বিজ্ঞানীরা আশা করছেন এসব তথ্য থেকে হ্যালির ধূমকেতু কী দিয়ে তৈরি আর কেমন করে তাদের উৎপত্তি সে সম্পর্কে জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে আসল সত্য জানা যাবে।
১৯৮৪ সালের ডিসেম্বর মাসে সোভিয়েত ইউনিয়ন হ্যালির ধূমকেতুর দিকে পাঠিয়েছে ভেগা-১ আর ভেগা-২ নামে দুটো নভোযান। ‘ভেনাস’ (শুক্র) আর ‘হ্যালি’ এই দুটো শব্দের আদ্য অক্ষর নিয়ে তৈরি হয়েছে রুশ ভাষার শব্দ ‘ভেগা’ জানুয়ারি ১৯৮৫-তে জাপান পাঠিয়েছে ‘সাকিগাকে’ (পথিকৃৎ) নামে একটি নভোযান। গত জুলাই মাসে ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা পাঠিয়েছে ‘জিয়ত্তো’ নভোযান। জিয়ত্তো মধ্যযুগের একজন বিখ্যাত ইতালীয় শিল্পীর নাম। আগস্টে জাপান পাঠিয়েছে ‘সুইসেই’ (ধূমকেতু) নামে আরেক নভোযান। এগুলো সবই ১৯৮৫ সালের মার্চ-এপ্রিল মাসে হ্যালির ধূমকেতু যখন পৃথিবীর সবচেয়ে কাছাকাছি আসবে তখন তাকে অভ্যর্থনা জানাতে যাচ্ছে। অতিথিকে সাদর সম্ভাষণ জানাতেই বেশ কিছু মাপ নেয়া হবে তার চালচরিত্রের। ইহার মুণ্ডের ভেতরে কেন্দ্রবস্তুর সবচেয়ে কাছাকাছি অর্থাৎ ৫০০ কিলোমিটারের মতো দূরত্ব দিয়ে যাবে ‘জিয়ত্তো’ নভোযান। এর পরই বেশি কাছে যাবে ভেগা নভোযান দু’টি। এদের কেন্দ্রবস্তুর দশ হাজার কিলোমিটার দূর থেকে নানা মাপজোখ নেবার কথা।
বিজ্ঞানীদের অনুমান যদি সত্যি হয় তাহলে এ অতিথির বয়স কম করেও সাড়ে চারশ’ কোটি বছর। অর্থাৎ সৌরজগতের বয়স যত, ঠিক ততটাই। পৃথিবীর ওপর জলবায়ুর ঝাপটায়, মানুষের ক্রিয়াকাণ্ডে বস্তুর ঘটেছে অনেক পরিবর্তন; অথচ এটির বুকে বস্তু রয়েছে বলতে গেলে তার জন্মের সময়কার সেই আঁতুড়ঘরের আদি অবস্থায়। এজন্যই ইহার বস্তু পরীক্ষা করতে বিজ্ঞানীদের আজ এমন তোড়জোড়। হ্যালির ধূমকেতুর ভেতরকার ধুলোপাথরের প্রচণ্ড আঘাতে যদি নভোযান আগেই বিকল হয়ে না যায় তাহলে এবার অনেক নতুন রহস্য উদ্ধার হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। হয়তো সৌরজগতের বৃষ্টি রহস্যের ওপরও পড়বে কিছু নতুন আলো।