অণুজীব নিয়ে কিছু কথা

আমাদেরে দেহের নানা ধরনের রোগের মূলে রয়েছে বিভিন্ন রকম জীবাণু বা অণুজীবএ তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত করেন লুই পাস্তুর, আজ থেকে মাত্র শ-খানেক বছর আগে। তিনিই প্রথম দেখান যে, কোন জিনিস পচে যাবার কারণও আসলে অণুজীবের ক্রিয়া। আমরা আসলে মোটা দাগে জীবাণু বলতে কাকে বুঝি জানো? হয়তো বলবে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ম্যালেরিয়া জীবাণু, কলেরা জীবাণু। তোমাদের ধারণা সঠিক। প্রাথমিকভাবে আমরা এইটুকু সঠিক জেনে সামনে আগাতে থাকি সেখানে পূর্ণাঙ্গ ধারণা লাভ করতে পারবে ইনশাল্লাহ। 
অণুজীব নিয়ে কিছু কথা, অণুজীব, অণুজীব সার কি, অণুজীব hsc, অণুজীব কাকে বলে, অণুজীববিজ্ঞান,  অণুজীবের ভূমিকা, মানব কল্যাণে অণুজীবের ভূমিকা, অণুজীববিজ্ঞান পড়ার সময় এখন, স্বাস্থ্য ঝুঁকি সৃষ্টিতে অণুজীবের ভূমিকা, অণুজীবের অর্থনৈতিক গুরুত্ব

বিজ্ঞানী লুই পাস্তর এর সময়ে একটি জটিল সমস্যা দেখা দেয়। অনেকে প্রশ্ন করেন, আমাদের চারপাশে যত অণুজীব রয়েছে তার সবই কি মানুষের জন্য ক্ষতিকর? পাস্তুর বললেন সব অণুজীব ক্ষতিকর নয়, বরং কিছু কিছু অণুজীব আছে যেগুলো আমাদের জীবন ধারণের জন্য একান্ত প্রয়োজন। অনেকে বলে থাকেন শতকরা ৯৫ ভাগ অণুজীব আমাদের জন্য উপকারী।

আমাদের আশেপাশে বেশ কিছু জীবাণু রয়েছে যেগুলো রীতিমতো উপকারীএকথা প্রমাণ করার জন্য বেশি দূরে যেতে হয় না। গরু, ছাগল প্রভৃতি গৃহপালিত প্রাণীর পেটে খাদ্য হজম করার অণুজীব বাস করে; এমনকি এরা বাস করে উই-এর পেটেও। তারাই এদের পাকস্থলীতে সেলুলোজ জাতীয় খাদ্য হজম করতে ভূমিকা রাখে। যদি এইসব অণুজীব মানুষের পেটে থাকতো তবে মানুষও সেলুলোজ জাতীয় খাদ্য তথা ঘাস, লতা-পাতা কাঁচা হজম করতে পারত। এখন গরু মোটাতাজাকরণ এ অনেক পদ্ধতি বের হলেও শুকনো খড় খেয়েও দিব্যি মোটাসোটা হয়ে উঠে, উই পোকা তৃপ্তিতে ভুরিভোজ করে পচা কাঠ চিবিয়ে।

পাস্তুর দেখেছিলেন সুস্থ মানুষের হাতে এবং দেহের ওপরের চামড়ায় নানা ধরণের অণুজীব বাস করে। তিনি বললেন এসব জীবাণু ধ্বংস করে ফেললে প্রাণীদের জীবন ধারণই অসাধ্য হয়ে উঠবে। কী অবাক লাগছে? পাস্তরের ধারণা কি আসলেই সত্যি? পাস্তরের সময়ে কোন প্রাণীর দেহের সব অণুজীব ধ্বংস করে ফেলার উপায় মানুষের জানা ছিল না। কিন্তু বর্তমান শতাব্দীর চল্লিশের দশকে কয়েকজন বিজ্ঞানী জীবাণুমুক্ত মুরগীর ছানা উৎপাদন করলেন, আর দেখা গেল কয়েক প্রজন্ম জীবাণুমুক্ত পরিবেশে রাখলেও তাদের জীবন ধারণে তেমন কোন অসুবিধা ঘটে না। অর্থাৎ পাস্তরের অনুমান উই পোকা বা রোমন্থক জাতীয় কিছু কিছু প্রাণীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেও সব উচ্চতর প্রাণীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয় না।

মানবশিশু জন্মগ্রহণ করার পর পরই মায়ের ও অন্যান্য লোকের স্পর্শ এবং আশেপাশের বিভিন্ন জিনিসের সঙ্গে সংযোগ থেকে তার গায়ে নানা ধরনের জীবাণু আস্তানা গাড়তে শুরু করে। বিশেষ করে গায়ের চামড়া, চোখ, নাক, মুখ, ক্ষুদ্রান্ত্র ও বৃহদন্ত্র, মূত্রদ্বার, মলদ্বার এসব জায়গায় প্রচুর অণুজীবের বাস। গায়ের চামড়া ছাড়া অন্যান্য অংশে ক্রমাগত দেহরস প্রবাহিত হয়। তাই এসব অঙ্গে যেসব জীবাণু বাস করে তাদের দেহকোষের সাথে রীতিমতো আঁটসাঁট হয়ে লেগে থাকতে হয়। 

কোন কোন অণুজীব বেছে নেয় দেহের বিশেষ
কোন অঙ্গ। যেমন কিছু জীবাণু আছে যারা অক্সিজেনহীন পরিবেশ পছন্দ করে; তারা বাস করে দাঁতের মাড়ির ফাঁকে। আবার দেহ কোন কোন অঙ্গকে অপ্রয়োজনীয় অণুজীবের প্রকোপ থেকে রক্ষা করে; যেমন পিত্তরস নিঃসরণের ফলে ক্ষুদ্রান্ত্রে অণুজীবের সংখ্যা হয় কম। 

আমাদের বৃহদন্ত্রে এমন কিছু অণুজীব বাস করে যেগুলো তাদের নিজেদের প্রয়োজনের চেয়ে বেশি পরিমাণে ভিটামিন তৈরি করেবিশেষ করে ভিটামিন কে ও বি১২, ফোলেট, পাইরিডক্সিন, রাইবোফ্লেভিন ইত্যাদি। এসব ভিটামিন সম্ভবত দেহ কিছু পরিমাণে আত্মস্থ করে। তবে এই ভিটামিন তৈরি মানুষের দেহের যে নিজস্ব ভিটামিন উৎপাদন ব্যবস্থা রয়েছে তার অতিরিক্ত। 

কোন কোন বিজ্ঞানী মনে করতেন আন্ত্রিক অণুজীব প্রোটিনের বিপাক ক্রিয়ায় উৎপন্ন ইউরিয়াকে ভেঙ্গে প্রয়োজনীয় নাইট্রোজেন তৈরি করে, এই নাইট্রোজেন আবার নতুন প্রোটিন তৈরি করতে কাজে লাগে। কিন্তু যেসব রোগীর বৃক্ক বিকল হয়ে গিয়েছে তাদের দেহে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে আন্ত্রিক অণুজীব ধ্বংস করে দিয়ে দেখা গেল তাতে বরং দেহে নাইট্রোজেনের ভারসাম্য উন্নত হয়। 

আন্ত্রিক অণুজীব শুধু যে পুষ্টি যোগায় না তা নয়, কোন কোন ক্ষেত্রে রীতিমতো ক্ষতিও করতে পারে। সাইকাড জাতীয় উদ্ভিদের বীজ থেকে সাইকাসিন নামে এক ধরনের শর্করা পাওয়া যায়। এই শর্করা মানুষ বা অন্য প্রাণীদের খাওয়ালে ক্যানসার হয়। কিন্তু ইঁদুরের দেহে এই ইনজেকশন দিয়ে দেখা গেল তাতে তার কোন ক্ষতি হয় না। এমনকি জীবাণুমুক্ত ইঁদুরকে এই শর্করা প্রচুর পরিমাণে খাইয়ে দেখা নিয়েছে তাতেও তার ক্যানসার দেখা দেয় না। 

এতে বোঝা যায় এই শর্করা নিজে ক্ষতিকর নয়, তবে আন্ত্রিক অণুজীবই এ থেকে ক্যানসার সহায়ক উপাদান সৃষ্টি করে। 

তাহলে পাস্তুর যে দেহের অণুজীবদের মানুষের জন্য উপকারী মনে করেছিলেন তার কি কোন মূল্য নেই? বিজ্ঞানীরা বলছেন, হ্যাঁ, এ কথারও মূল্য রয়েছে। দেহের জীবাণুরা নিজ নিজ এলাকা এমনভাবে অধিকার করে রাখে যে, সেখানে অন্য ক্ষতিকর জীবাণু আস্তানা গাড়বার সুযোগ পায় না। দেহের এসব জীবাণু নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে কিছু জীবাণুনাশী রাসায়নিক বস্তুও তৈরি করে, অন্য অণুজীব সেখানে আস্তানা গাড়তে এলে এই অ্যান্টিবায়োটিকের প্রভাবে তারা মারা পড়ে।

আমাদের মুখের কথা ধরা যাক। মুখে নানা ধরনের স্ট্রেপটোক্কাস জাতের অণুজীব বাস করে। এরা আমাদের ক্ষতি করে না, বরং নিউমোনিয়া, মেনিনজাইটিস, যক্ষ্মা প্রভৃতি মারাত্মক রোগের জীবাণুদের ধ্বংস করে। আসলে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ ব্যবহার করে আমরা যখন দেহের রক্ষাকারী অণুজীবদের ধ্বংস করে ফেলি তখন ক্ষতিকর জীবাণুরা আমাদের কাবু করার সুযোগ পায়। তেমনি যেসব শিশুর দেহে প্রতিরোধী অণুজীব কম থাকে তাদেরই টনসিল ও নিউমোনিয়ার প্রদাহ দেখা দেয়।

অনেক পরীক্ষা থেকে দেখা গিয়েছে, অন্ত্রের অণুজীবরা কলেরা, আমাশয় প্রভৃতি রোগের জীবাণুকে প্রতিরোধ করতে পারে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ফলে উপকারী অণুজীবদের ধ্বংস করা হলে এসব রোগের জীবাণুর আক্রমণের সম্ভাবনা বাড়ে। ক্ষতিকর জীবাণুর বৃদ্ধি প্রতিহত করা ছাড়াও উপকারী অণুজীবরা এসব জীবাণুর দেহ নিঃসৃত অধিবিষকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়। এজন্য বিজ্ঞানীরা মনে করেন সাধারণ ডায়রিয়ার জন্য অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ ব্যবহার করা হলে তাতে উপকারী অণুজীব ধ্বংস হয়ে দেহ আরো মারাত্মক রোগের শিকার হতে পারে। এ ধরনের ডায়রিয়া সাধারণত ওষুধ ব্যবহার না করলেও আপনা আপনি সেরে যায়।

অবশ্য সব ক্ষেত্রেই যে দেহের অণুজীবের প্রভাব উপকারী তা নয়। পরীক্ষায় দেখা গিয়েছে কোন কোন রোগের আক্রমণে রোগীর অনাক্রম প্রতিরোধ ব্যবস্থা ক্ষতির কারণ হতে পারে। সেসব ক্ষেত্রে দেহের অণুজীবের প্রভাব আরো বেশি ক্ষতি করে। আর তাই ইঁদুরকে জীবাণুমুক্ত করা হলে সে ইঁদুর হেপাটাইটিস ভাইরাস দ্বারা সহজে রোগাক্রান্ত হয় না।

কারো বৃহদন্ত্রে ক্যানসার দেখা দিলে সচরাচর তার দেহে কোন কোন বিশেষ জাতের জীবাণু আস্তানা গাড়ে। এর মধ্যে পড়ে বিশেষ জাতের স্ট্রেপটোক্কাস এবং অন্যান্য জাতের ব্যাকটেরিয়া যেগুলো সাধারণত সুস্থ মানুষের দেহে দেখা যায় না। এসব অণুজীব নিজেরা ক্ষতিকর নয় তবে এদের সাথে ক্যানসার কোষের বিশেষ ধরনের মিথোজীবিতা (এই এমন একটি ব্যবস্থা বা সিস্টেম যেখানে একাধিক জীবাণু সহবস্থানের মাধ্যমে বসবাস করে। অর্থাৎ একে অপরের দ্বারা উপকৃত হয়। শৈবাল ও ছত্রাকের মাঝেও এই ধরণের সহবস্থান দেখা যায়।) রয়েছে। এমন অণুজীবের উপস্থিতি অনেক সময়ে বৃহদন্ত্রে ক্যানসারের ইঙ্গিত দেয়। 

কোন কোন বিরল ক্ষেত্রে রোগ জীবাণু দেহে স্বাভাবিক অণুজীবের ওপর নির্ভর করে আস্তানা গাড়ে। অ্যামিবিক আমাশয় এর একটি দৃষ্টান্ত। অণুজীবমুক্ত প্রাণীদেহে সচরাচর অ্যামিবারা সহজে বাসা বাঁধতে পারে না। আবার কখনো কখনো দেহের অণুজীব বাইরে থেকে অন্য রোগের আক্রমণকে জটিল করে তুলতে পারে। যেমন কদাচিৎ নিউমোনিয়ায় নাক-মুখের অণুজীব থেকে বা জটিল আমাশয়ে বৃহদন্ত্রের অণুজীব থেকে সৃষ্ট অন্য সংক্রমণ রোগীর অবস্থা নাজুক করে তোলে।

আসলে কোন রোগে বা আঘাতে যখন উচ্চতর প্রাণীদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে আসে তখন দেহের স্বাভাবিক যেসব অণুজীব সচরাচর অতি নিরীহ আর নিরুপদ্রব মনে হয় তারাও রীতিমতো হিংস্র রূপ নিতে পারে। 

বিজ্ঞানীদের এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে বোঝা যায় দেহের স্বাভাবিক অণুজীব শত্রু না মিত্রএ প্রশ্নের কোন স্পষ্ট কোন জবাব নেই। এসব অণুজীব কখনো বাইরের ক্ষতিকর জীবাণুদের ঠেকিয়ে রেখে বন্ধুর সুলভ কাজ করে। আবার কখনো সুযোগ পেলে নিজেরাই আগ্রাসী হয়ে উঠে শত্রুর মতো আচরণ করে।

এ পরিস্থিতিতে চিকিৎসাবিদরা চেষ্টা করেন অণুজীবদের ক্ষতিকর চরিত্রকে দমন করে রেখে উপকারী দিককে কাজে লাগাতে। এক সময়ে জীবাণু ধ্বংস করার জন্য তাঁরা ব্যাপকভাবে অ্যান্টিবায়োটিক (এটি শুধুমাত্র ব্যাকটেরিয়াকে প্রতিরোধ করতে পারে। ভাইরাসকে পারে না।) ব্যবহার করতেন। কিন্তু দেখা গেল তাতে বরং অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী অন্য অণুজীব দেহে আস্তানা গেড়ে বসে। সেজন্য আজকাল অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে অনেক বেশি সতর্কতা অবলম্বন করা হয় এবং বেছে বেছে এমন অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করা হয় যাতে শুধু ক্ষতিকর জীবাণু ধ্বংস হয় অথচ উপকারী অণুজীব অক্ষত থাকে। বলা বাহুল্য, এ পদ্ধতির সাফল্যের জন্য দেহের স্বাভাবিক অণুজীব সম্পর্কে আরো প্রচুর গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।

অণুজীব নিয়ে কিছু কথা, অণুজীব, অণুজীব সার কি, অণুজীব hsc, অণুজীব কাকে বলে, অণুজীববিজ্ঞান,  অণুজীবের ভূমিকা, মানব কল্যাণে অণুজীবের ভূমিকা, অণুজীববিজ্ঞান পড়ার সময় এখন, স্বাস্থ্য ঝুঁকি সৃষ্টিতে অণুজীবের ভূমিকা, অণুজীবের অর্থনৈতিক গুরুত্ব

সম্প্রতি কোভিড-১৯ বা লভেল করোনা ভাইরাস বিজ্ঞানীদেরকে নতুন করে তীব্রভাবে ভাবিয়ে তুলেছে। আসলে জানো এটা একধরণের ভাইরাস। তবে এর বিশেষ নাম আছে। ইমার্জিং ভাইরাস বলা হয়ে থাকে একে। এর কারণ হলো এটি মানুষের দেহ থেকে মানুষের দেহে আসে নাই। বরং ইহা অন্য কোনো প্রাণী (বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে বাঁদুরের দেহ থেকে) হতে মানুষের দেহে আগমন ঘটিয়েছে। এই ভাইরাস ছাড়াও সার্স, মার্স, এইচআইভি সহ অনেক ভাইরাস অন্যান্য প্রাণীর দেহ থেকে মানুষের দেহে সংক্রমণ ঘটায়। পরে এটির জিনগত পরিবর্তন ঘটতে থাকে। এটি নিয়ে আলোচনা করলে বিশাল বড় একটা পোস্ট লেখা যায়। তাই আমরা আর গভীর আলোচনা করবো না। তবে করোনা ভাইরাস থেকে বাঁচতে হলে আপাতত স্বাস্থ্যবিধি মানা ও প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির উপায় জানা ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই।

 

শেয়ার
আজকের সেরা খবর গতকালের সেরা খবর
সবার আগে কমেন্ট করুন
কমেন্ট করতে ক্লিক করুন
comment url